শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু

১৪০৭ শকাব্দ (ইং ১৪৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী), তখন ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যা। চন্দ্রগ্রহণ চলছিল। ভারতীয় বৈদিক রীতি অনুসারে, চন্দ্রগ্রহণের সময় দিনান্তে মানুষ সাধারণত গঙ্গা অথবা কোন পবিত্র নদীতে গিয়ে স্নান করেন এবং জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সকলে তখন সর্বশ্রেষ্ঠ বৈদিক মহামন্ত্র “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” জপ-কীর্তন করছিলেন। দিব্য হরিনামের মঙ্গল ধ্বনিতে চারিদিক মাতিয়ে পশ্চিম বাংলার নবদ্বীপের শ্রীধাম মায়াপুর নামক স্থানে আবির্ভূত হন কলিযুগের পাবনাবতার, সকলের সৌভাগ্যের উদয়কারী সেই মায়াপুরচন্দ্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সেই দুষ্ট বালকটির নাম #নিমাই। নিম বৃক্ষের নিচে জন্মগ্রহন করায় তার এই নাম।
মহাপ্রভু যখন প্রবলভাবে হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন তখন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ তাঁর এবং ভক্তদের বিরুদ্ধে চাঁদ কাজীর কাছে অভিযোগ করে। নবদ্বীপের মুসলমান কাজী ব্রাহ্মণদের এই অভিযোগটিতে প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমে তিনি মহাপ্রভুর অনুগামীদের উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্তন করতে নিষেধ করেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অনুগামীদর কাজীর সেই নির্দেশ অমান্য করতে নির্দেশ দেন, এবং তাঁরা পূর্বের মতোই সংকীর্তন করে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর পেয়াদা পাঠান এবং তারা সংকীর্তন কারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়। এই ঘটনার কথা শুনে মহাপ্রভু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি এক বিরাট আইন-অমান্য আন্দোলন করেন। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতবর্ষে প্রথম আইন-অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। হাজার হাজার মৃদঙ্গ এবং করতাল সহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেন, এবং কাজীর আইন অমান্য করে এই শোভাযাত্রা নবদ্বীপের পথে পথে হরিনাম কীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে যখন শোভাযাত্রাটি কাজীর বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন ভয়ে কাজী তাঁর বাড়ির উপরতলার একটি ঘরে লুকিয়ে থাকেন। সেই বিশাল জনসমাবেশ কাজীর বাড়ির সামনে সমবেত হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে, কিন্তু মহাপ্রভু তাদের শান্ত হতে বলেন। মহাপ্রভুর আশ্বাস পেয়ে অবশেষে কাজী তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে কোরান ও হিন্দু-শাস্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় তিনি গো-বধের ভয়াবহ পরিনাম তুলে ধরেন।

“তোমরা জীয়াইতে নার-বধমাত্র সার।
নরক হইতে তোমার নাহিক নিস্তার।।
গো-অঙ্গে যত লোম, তত সহস্র বৎসর।
গো-বধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।”
এভাবে মহাপ্রভু শাস্ত্র যুক্তির মাধ্যমে গোবধ এবং সবধরণের যজ্ঞ নিষিদ্ধ করলেন। তিনি একমাত্র যজ্ঞ হিসেবে হরিনাম সংকীর্তনকে জগতমাঝে প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন কাজী মহাপ্রভুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত সংকীর্তন যজ্ঞে কেউ যেন কখনও বাধা না দেয়, এবং তিনি তাঁর উইলে লিখে যান যে, তাঁর বংশের কেউ যদি সংকীর্তনে বাধা দেয়, তাহলে সে তৎক্ষণাৎ বংশচ্যুত হবে। নবদ্বীপে মায়াপুরের সন্নিকটে এখনও শ্রীচাঁদ কাজীর সমাধী আছে।
এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিরীহ বৈষ্ণব ছিলেন না। বৈষ্ণব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের ভক্ত এবং প্রয়োজন হলে তিনি সিংহবিক্রমে যথার্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

দুই ভাই-জগাই ও মাধাই এর কথা কি মনে আছে ?

মহাপ্রভুর নির্দেশে শ্রীনিত্যানন্দ এবং হরিদাস ঠাকুর সর্বত্র হরিনাম প্রচার করেন। ঐ সময়ের সর্ব সবনিকৃষ্ট পতিত হচ্ছেন দুই ভাই-জগাই ও মাধাই। পৃথিবীতে এমন কোন পাপ নেই যা তারা করেনি; মাংসাহার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট-সবকিছু। সারাদিন মদের নেশার বিভোর হয়ে থাকত এই দুইজন। তাদের এই পতিত দশা দেখে নিত্যানন্দ প্রভু এবং হরিদাস ঠাকুর তাদেরকে হরিনাম করতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধ শুনে মাতাল দুটি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল এবং অশ্লীল গালাগালি দিতে দিতে তাদেঁরকে তাড়া করতে শুরু করল। পরের দিন আবার তাঁরা দুই মাতালের কাছে গিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করতে অনুরোধ করলেন। পুনরায় ক্রুদ্ধ হয়ে মাধাই একটি কলসির কানা দিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় আঘাত করল, এবং সেই আঘাতের ফলে প্রভুর কপাল কেটে দরদর ধারায় রক্ত ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু এতই করুনাময় যে, এই কাজের জন্য কোন রকম প্রতিবাদ না করে তিনি বললেন “তুমি যে আমাকে কলসির কানা ছুড়ে মেরেছ তাতে আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু আমার একমাত্র অনুরোধ যে তুমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির নাম কীর্তন কর। ইতিমধ্যে নিত্যানন্দ প্রভুর আঘাতের সংবাদ পেয়ে মহাপ্রভু অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করলেন দুই পাপীকে সংহার করার জন্য। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তাদের হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন এবং মহাপ্রভুকে তাঁর অবতরনের উদ্দেশ্য মনে করিয়ে দিলেন। মহাপ্রভু অবতরনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কলিযুগের সমস্ত অধপতিত মানুষকে কৃষ্ণপ্রেম প্রদানের মাধ্যমে উদ্ধার করা এবং এই দুই ভাই-জগাই মাধাই হচ্ছে সেই অধপতিত মানুষের আদর্শ দৃষ্টান্ত। প্রকৃতপক্ষে, বৈদিক সমাজের বিলুপ্তি ও বর্তমান যুগের প্রভাবে অধিকাংশ মানুষই একেকটি জগাই মাধাইয়ে পরিণত হয়েছে। তবুও আমাদের মতো জগাই মাধাইদের জন্য একমাত্র সৌভাগ্যের বিষয় হল হরিনাম মহামন্ত্রকে জীবনের সম্বলরূপে গ্রহন করা।
জগাই মাধাই সমস্ত পাপকর্ম বর্জন করে পরম দয়ালু ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় গ্রহন করল এবং কৃষ্ণপ্রেম লাভ করল।
পাপী তাপী যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল
তার সাক্ষী জগাই আর মাধাই।।

এভাবে মহাপ্রভু সবচেয়ে পতিত ব্যাক্তিদেরও কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করেছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন কলিযুগের অধপতিত জীবদের সৌভাগ্য আনয়নকারী সুহৃদ। যে দুর্লভ বস্তু-কৃষ্ণপ্রেম হাজার হাজার বছর তপস্যা করে লাভ করা যায় না, যা গোলোক বৃন্দাবনের সবচেয়ে গোপনীয় বস্তু, সেই কৃষ্ণপ্রেম আপামর মানুষকে অকাতরে তিনি বিতরণ করেছেন অত্যন্ত করুণার বশবর্তী হয়ে। শুধুমাত্র দিব্য হরিনাম উচ্চারণের মাধ্যমেই এই দুর্লভতম কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা যায়। আর, এই হরিনামকে বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছেন মহাপ্রভুরই এক অন্তরঙ্গ প্রেরিত দূত, আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) এর প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।
মহাপ্রভু ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম, সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম।” তাঁর এই ভবিষ্যত বাণীকে সার্থক রূপদান করেছেন শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁরই কৃপাতে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদশূণ্য হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করছে। তিনিই প্রকৃত জাতিসংঘ গঠন করেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপার করুণায়। এই হরিনামের ফলেই সবাই লাভ করছে দিব্য আনন্দ ও সুখি জীবন।

আসুন সবাই এখন আমরা এই মুহূর্ত থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই প্রতিদিন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করতে এবং কৃষ্ণ সেবায় নিজেদেরকে নিযুক্ত রাখতে।

“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।”

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কী, জয় !!!
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু Reviewed by Apon on August 01, 2017 Rating: 5
Powered by Blogger.