সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস





উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সভ্যতাটির নাম হলো সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদ অববাহিকা। প্রথম দিকে এই সভ্যতা পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায় বিকাশ লাভ করে। পরে তা প্রসারিত হয় ঘ¹র-ভাকরা নদী উপত্যকা ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল পর্যন্ত। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমদিকের রাজ্যগুলো, দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান এবং ইরানের বালোচিস্তান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত ছিল।

১৯২২-২৩ সালের কথা। ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শালের ভারতীয় সহকারী রাখালদাস অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো এলাকায় বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। তার ক’দিন আগেই মহেঞ্জোদারোর কয়েকশ’ মাইল উত্তরে পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় একটি প্রাচীন শহরের চার-পাঁচটি স্তরবিশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল। এরপরই আশপাশের এলাকাজুড়ে শুরু হয় অনুসন্ধান। সেই সময় ভারত ও পাকিস্তানের নানা জায়গায় এ রকম আরো শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, এসব শহর একটি স্বতন্ত্র সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। এই সভ্যতাই সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ান সাহিত্যে সম্ভবত যার নাম মেলুহা। ভৌগোলিক বিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম সভ্যতা। এই সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতি বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতা থেকে এই সভ্যতাকে একদমই আলাদা করে তুলেছে।

ঐতিহাসিক মতে, এই সভ্যতা ছিল তাম্র-ব্রোঞ্জ (ক্যালকোলিথিক) যুগের সভ্যতা। কারণ লোহার ব্যবহার এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অজ্ঞাতই ছিল। এই সভ্যতার সামগ্রিক সময়কাল ধরা হয় ৫৫০০-১৩০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ। সিন্ধুবাসীদের প্রধান কৃষিজ ফসল ছিল গম, যব, মটর, খেজুর, তিল ও সরিষা। সভ্যতার অনেক আগেই কৃষির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল।

কেমনভাবে শেষ হলো এ নগরভিত্তিক প্রাচীন সভ্যতাটি, তা নিয়ে নানা ঐতিহাসিকের নানা মত রয়েছে। যেহেতু ওই সময়কার কোনো নির্ভরযোগ্য রেকর্ড নেই, তাই ঐতিহাসিকদের পক্ষে বিভিন্ন ছোটখাটো তথ্যের ওপর ভর দিয়ে অনুমান করতে হচ্ছে। তবে খনন করে একটা ব্যাপার জানা গেছে, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ শতাব্দীর মধ্যে।

ওখানকার বাসিন্দারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না এমন বিপর্যয়ের জন্য। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করছেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণেই সিন্ধু সভ্যতা ছারখার হয়ে গেছে। নিশ্চিতভাবে সেই শত্রুরা ছিল কোনো বর্বর জাতি এবং যুদ্ধে পারদর্শী। এ মতের সপক্ষে সবার আগে যে যুক্তি দেওয়া হয় তা হলো, আর্যরা এর পরই এসে ওইসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। হয়তো তারাই ধ্বংস করেছিল সিন্ধু সভ্যতার ওই সুন্দর শহরগুলো। আর্যদের মহাকাব্যেও এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেখানে তাদের বড় বড় শহর দখলের বীরত্বগাথা লেখা রয়েছে। মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপ থেকে তেমন একটি প্রমাণও মিলেছে। ওখানে খনন করার পর একটি মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। যা দেখলে বোঝা যায়, নৃশংস ঘটনার জেরেই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ তত্ত্বকে পুরোপুরি মানতে পারেননি অনেক ঐতিহাসিক। কারণ মহেঞ্জোদারো ছাড়া আর কোনো শহরে অমন কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবিদের কারো কারো ধারণা, হয়তো তখন বহিঃশত্রু হানা দিয়েছিল। কিন্তু শুধু সেই জন্যই অত প্রাচীন শহর ছারখার হয়নি। তাছাড়া এখন গবেষণা করে দেখা যাচ্ছে, সিন্ধু সভ্যতার প্রধান শহরগুলো ধ্বংস হওয়ার প্রায় ৫০০ বছর পর আর্যরা ওই অঞ্চলে এসেছিল।

আর্যদের মতো বহিঃশত্রু হানার পাশাপাশি আরো একটি অনুমানও জোরদার হয়েছে। সেটা হলো প্রাকৃতিক পরিবর্তন। খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার বছর থেকে সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলোর চারপাশের প্রকৃতি বদলে যেতে থাকে। ঘন ঘন বন্যা হতে থাকে শহরগুলোয়। অনেক শহরের বাড়িঘর দেখে ঐতিহাসিকরা বুঝতে পারেন, সেখানে প্রায়ই বন্যা হতো। প্রথমদিকে শহরের বাসিন্দারা বাড়িগুলো ভালোভাবে সারালেও পরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তখন তারা ভাঙাচোরা ইট দিয়েই কোনোমতে সারিয়ে নিত। নিকাশি ব্যবস্থারও যতœ নেওয়া বন্ধ হয়। এ পরিস্থিতিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকে। গরম বাড়ে। জায়গাটা ক্রমেই শুকনো মরুভূমি হয়ে যেতে লাগল। যে সভ্যতা কৃষির ওপর জোর দিয়ে গড়ে উঠেছিল, যেখানে বিরাট শস্যের গোলা পাওয়া গেছে, সেই সভ্যতা কখনো এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকে? তাই ঐতিহাসিকদের আন্দাজ, এর জেরেই ধ্বংস হয়ে গেছে সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু কেন ধ্বংস হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।




সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস Reviewed by Apon on August 01, 2017 Rating: 5
Powered by Blogger.