বৃন্দাবন তীর্থ স্থান



বৃন্দাবন ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত মথুরা জেলায় অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ তীর্থ স্থান। একে হিন্দুদের মহাতীর্থ বলা হয়। এ স্থানটি খুবই প্রাচীন এবং কৃষ্ণলীলার সজীব চিত্র বলে মনে হয়।
গোড়ার কথা
পঞ্চপাণ্ডব (যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব) মহাপ্রস্থান করার পর শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভ মথুরার রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। একদিন বজ্রনাভের মা রোচনা দেবী তাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটি মূর্তি তৈরী করার জন্য আদেশ দেন। মূর্তি প্রস্তুত হলে রোচনা দেবী বলেন, মুখ ছাড়া এ মূর্তি শ্রীকৃষ্ণের মতো হয় নাই। দ্বিতীয় মূর্তি প্রস্তুত হলো বটে কিন্তু তাতে কেবল বক্ষঃস্থল ভিন্ন শ্রীকৃষ্ণের আর কোন অঙ্গের মিল দেখা যায় নাই। তৃতীয় মূর্তিতে দুই চরণ ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় নাই। বজ্রনাভ চতুর্থ মুর্তি তৈরীতে উদ্যত হইলে জননী বলেন, তার আর দরকার নেই। এ তিন মূর্তিরই তুমি প্রতিষ্ঠা কর। মায়ের আদেশে বজ্রনাভ গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনগোপাল নামকরণ করে ব্রজমণ্ডলের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেন এবং অন্যান্য স্থানে কৃষ্ণলীলার স্মরণ চিহ্ন হিসেবে প্রকৃত স্থানেই গ্রাম, কুণ্ড বা কুপ প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষ্ণের শূরসেন বংশীয় দায়াদগণ ভাগবৎ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
পরবর্তীতে এ ধর্ম ক্ষুণ্ন হয়ে যায় এবং ব্রজমণ্ডলে সৌর, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য স্থাপিত হয়। এর ফলে বৃন্দাবনের তীর্থমাহাত্ম্য বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে।
খ্রীষ্টিয় একাদশ শতাব্দীতে গজনীর মামুদ মথুরা ও মহাবন আক্রমণ ও ধ্বংস করে তীর্থের গৌরব একেবারে নষ্ট করে ফেলেন। বৃন্দাবন প্রকৃত অর্থেই বনে পরিণত হয়ে যায়। দাসরাজ কুতবুদ্দিনের সময়ে মথুরামণ্ডল দিল্লী রাজ্যের অধিভূক্ত হয়। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বৃন্দাবনের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হয়। এ সময়ে চৈতন্যদেবের আদেশে সনাতন, রূপ প্রভৃতি গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বৃন্দাবনে এসে বাস করেন এবং হারানো তীর্থ গৌরব পুণরুদ্ধারে যত্নবান হন।
বৃন্দাবনের মন্দিরসমূহ
পুরাতন মন্দির তিনটি ব্যবহার উপযোগী না দেখে চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত বহড়ু গ্রামের জমিদার দেওয়ান নন্দকুমার বসু ৮১২১ খ্রীঃ বহু ব্যয় করে তিনটি মন্দির প্রস্তুত করেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য যে সকল বিগ্রহগুলোর জন্য মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ- শেঠের মন্দির; সাহাজীর মন্দির; ব্রহ্মচারীর মন্দির; লালাবাবুর মন্দির অন্যতম। এছাড়াও, অনেক মন্দির ভক্ত বৈষ্ণবদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
নিধুবন, কেশীঘাট, ব্রহ্মকুণ্ড, গোপীস্বর মহাদেব, চৌষট্টিমহান্তের সমাজ, সাজাহনপুরের লালা ব্রজকিশোর ক্ষত্রীর প্রতিষ্ঠিত রাধাবিনোদের মন্দির, তানসেন গুরু হরিদাস স্বামীর প্রতিষ্ঠিত বাঁকে বিহারীর মন্দির উল্লেখযোগ্য।
বন বিবরণ
বৃন্দাবনের পরিধি পাঁচ ক্রোশ। দ্বাদশঘাট এটির অন্তর্গত। ব্রজচৌরাশী ক্রোশের পরিক্রমাকে ‘বন’ করা বলে। এ পরিক্রমা ভাদ্র কৃষ্ণা দশমীতে আরম্ভ করে ভাদ্র শুক্লা দশমীতে শেষ হয়। বনগুলোর নাম হলো - মধুবন, তালবন, কুমুদবন, বহুলাবন, কামাবন, খদিরবন, বৃন্দাবন, ভদ্রবন, ভাণ্ডিরবন, খেলনবন, লৌহবন ও মহাবন। গোকুল, গোবর্ধন, নন্দগ্রাম, বর্ষাণ প্রভৃতি স্থানগুলো ২৪ উপ-বনের অন্তর্গত। সমগ্র পরিধির মধ্যে ১১টি দেবীমূর্তি ও ৯টি মহাদেবমূর্তি বিদ্যমান।
অনুষ্ঠানাদি
ঝুলনযাত্রাই বৃন্দাবনের সর্বপ্রধান পর্ব। তার পরেই অন্নকূট যাত্রা। শেষোক্ত পর্ব দীপান্বিতা অমাবস্যার পরদিনে সম্পন্ন হয়।
কোলকাতার রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর যখন বৃন্দাবনবাস করেন, সে সময়ে তিনি ইংরেজ সরকারকে আবেদন করে এ আদেশ প্রচার করেছিলেন যে, ইংরেজরা বৃন্দাবনের মধ্যে শিকারের উদ্দেশ্যে পশু বা পাখী বধ করতে পারবে না।
কৃষ্ণের “বৃন্দাবনং পরিত্যজ্য পাদমেকং ন গচ্ছতি” - এ উক্তির সারমর্ম হৃদয়ে উপলদ্ধি করে বৈষ্ণবগণ এ স্থানকে সর্বপ্রধান তীর্থ ও বাঞ্ছনীয় বাসস্থান হিসেবে পরিগণনা করে।
বৃন্দাবন তীর্থ স্থান বৃন্দাবন তীর্থ স্থান Reviewed by Apon on August 01, 2017 Rating: 5
Powered by Blogger.