দোলযাত্রা

‘রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও যাও যাওগো এবার যাবার আগে
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে,
অশ্রুজলের করুণ রাগে ...
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও।’
দোলযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসব পালনের রীতি স্থান ভেদে ভিন্ন হলেও উৎসবের মূল সুরে কোনো ভিন্নতা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত গানের কথাতেই যেন দোলযাত্রার মূল সুর ফুটে ওঠে। ভারতে এবং নেপালে এই উৎসবকে ‘হোলি’ বলা হয়। আবার এই একই উৎসবের অপর নাম ‘বসন্তোৎসব’। শান্তিনিকেতনে বসন্তের আগমন উপলক্ষে নাচ-গান, আবৃত্তি ও নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটিই বসন্তোৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ দোলপূর্ণিমার দিনই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়। ফাল্গুনের ওই একই পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা।
বাংলাদেশে এই উৎসবটি ‘দোলযাত্রা’, ‘দোলপূর্ণিমা’ নামে পরিচিত। দোলযাত্রা হিন্দু বৈষ্ণবদের উৎসব। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী এ দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকা এবং তার সখীদের সঙ্গে আবির খেলেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। এ কারণে দোলযাত্রার দিন এ মতের বিশ্বাসীরা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে নগর কীর্তনে বের হন। এ সময় পরস্পর তারা রং খেলে আনন্দে মেতে ওঠেন। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন। ফলে এই তিথিকে ‘গৌরপূর্ণিমা’ও বলা হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬– ১৫৩৪) ছিলেন হিন্দু সন্ন্যাসী এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাকে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার মনে করেন। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন।
দোলপূর্ণিমায় এই শ্রীকৃষ্ণেরই আরাধনা করা হয়। এর অনুষঙ্গ হিসেবে ভক্তগণ মেতে ওঠে রং খেলায়। এই উৎসবের পেছনে নানান পৌরাণিক লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান ‘হোলিকা দহন’। এর থেকেই ‘হোলি’ কথাটির উৎপত্তি। বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’ আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’। বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্য দেখা যায়। এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলার বার্তা সঞ্চারিত হয়। কিন্তু মধ্যভারত বা পশ্চিমভারতে এই উৎসবে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনিই প্রাধান্য পায়। প্রহ্লাদ দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর সন্তান। হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার বরে বলীয়ান ছিলেন। ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন, কোনো পশু কিংবা মানুষ তাকে হত্যা করতে পারবে না। অর্থাৎ মহিষাসুরের কাহিনির মতোই, হিরণ্যকশিপু এই বর পেয়ে এতটাই উন্মত্ত হয়ে উঠলেন যে, তিনি দেবলোক আক্রমণ করলেন। দেবলোক হয়ে উঠল তার পরম শত্রু। কিন্তু প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত। এতে হিরণ্যকশিপু ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হলেন। পুত্রকে নানাভাবে বুঝিয়েও যখন সে তাকে বিষ্ণুপ্রেম থেকে বিচ্যুত করতে পারলেন না তখন সে প্রহ্লাদকে কৌশলে হত্যা করার নানান ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা বরপ্রাপ্তা ছিলেন। তিনি বর পেয়েছিলেন যে, অগ্নি তাকে বধ করতে পারবে না। ফলে হিরণ্যকশিপু এবার চাতুরি করে হোলিকার কোলে বালক প্রহ্লাদকে বসিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। প্রহ্লাদ কিন্তু এতে বিচলিত হলেন না। তিনি বিষ্ণুকে স্মরণ করলেন। বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুণ্ড থেকে অক্ষত অবস্থায় মুক্তি পেলেন। কিন্তু হোলিকা প্রাপ্ত বরের অন্যায় ব্যবহার করায় আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। হিরণ্যকশিপু তখন প্রহ্লাদকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, তুই যে এতো বিষ্ণুভক্ত সে কি সব জায়গায় আছে?
প্রহ্লাদ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, অবশ্যই সে সর্বত্র বিরাজমান। তখন হিরণ্যকশিপু বললেন, সে কি এই প্রাসাদের খুঁটির মধ্যেও আছে যে সেখান থেকে বের হয়ে এসে তোমাকে বাঁচাবে? প্রহ্লাদ বললেন, অবশ্যই আছে।
এরপর হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে আক্রমণ করতে গেলে ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার রূপে সেই বিশাল খুঁটি থেকে বের হয়ে এসে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন।
এখনও রূপক হিসেবে কোনো কোনো অঞ্চলে হোলিকাকে অগ্নিকুণ্ডে বসিয়ে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। হোলি উৎসবের আগের দিন অত্যন্ত ধুমধাম করে পালন করা হয় ‘হোলিকা দহন’।। এই উৎসবটির মধ্য দিয়ে ভালো কাজের জয় আর মন্দের ক্ষয়কেও বোঝানো হয়ে থাকে। আগুনকে শক্তির প্রতীক হিসেবে মনে করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে অমঙ্গল বা কুপ্রভাবকে ধ্বংস করা হয়। যদিও বাংলায় এই আয়োজন খুব কমই চোখে পড়ে। অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত লোককথার ভিন্নতা রয়েছে। ধর্মীয় গবেষকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদযাপন রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারী এবং তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন। এই রং উৎসবটিই বাংলাদেশে এখনও প্রচলিত রয়েছে। এ দিন পরস্পরকে রং দিয়ে রাঙানোর মাধমে আমরা আসলে সেই পুরাণে ফিরে যাই, স্মরণ করি শ্রীকৃষ্ণের অপার লীলা।
দোলযাত্রা দোলযাত্রা Reviewed by Apon on August 01, 2017 Rating: 5
Powered by Blogger.